সক্রেটিসপূর্ব দর্শন

বিশ্বতত্ত্ব এবং পদার্থের অধিবিদ্যা

প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকরা জড়জগতের উৎপত্তি এবং বৈশিষ্ট্যের উপর মনোনিবেশ করেছিলেন বলে তাদেরকে প্রায়শই বিশ্বতাত্ত্বিক (cosmologist) বা প্রকৃতিবিদ (naturalist) হিসেবে অভিহিত করা হয়। যদিও শুরুতে তাদের চিন্তাধারায় অদ্বৈতবাদী (monistic) মতবাদের—যার মূল বক্তব্য হল, বিশ্বের উৎপত্তি হয়েছে একটি একক মৌলিক দ্রব্য/পদার্থ থেকে—প্রাধান্য ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে ধীরে ধীরে বহুত্ববাদী (pluralistic) তত্ত্ব— যা বলে বিশ্বের উৎপত্তি হয়েছে একাধিক মৌলিক দ্রব্য/পদার্থ থেকে—এর জায়গা করে নেয়।

অদ্বৈতবাদী বিশ্বতত্ত্ব

সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত অনুযায়ী মিলেতুসের থেলিসকে (Thales, জী. খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতক) ধরা হয় প্রথম গ্রিক দার্শনিক হিসেবে। ‘দার্শনিক’ (প্রজ্ঞাপ্রেমী) শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়নি তখনো, সেই সময়ে থেলিসকে ধরা হতো কিংবদন্তী সাতজন জ্ঞানী মানুষের (Sophoi) একজন হিসেবে, অনুমানমূলক অন্তর্দৃষ্টি নয় বরং উদ্ভাবনী ও প্রায়োগিক জ্ঞানের অধিকারীদেরকে এই দলভুক্ত ধরা হতো। থেলিস এই গুণগুলোর পরিচয় দিয়েছিলেন ব্যাবিলনীয় গাণিতিক জ্ঞানকে আরো সুনির্দিষ্ট একটি ভিত্তি দেয়ার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে এবং এই জ্ঞানকে বাস্তবভিত্তিক সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য (যেমন তীর থেকে জাহাজের দূরত্ব নিরূপন, পিরামিডের উচ্চতা পরিমাপ, ইত্যাদি) ব্যবহার করে। থেলিস একবার একটি সূর্যগ্রহণের সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করে বেশ আলোচিত হয়েছিলেন, তবে আদতে মনে হয় ভবিষ্যদ্বাণী নয়, তিনি ব্যাবিলনীয় জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞানের ভিত্তিতে সূর্যগ্রহনের একটা প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন মাত্র।

থেলিসকে প্রথম গ্রিক দার্শনিক বলে আখ্যা দেয়া হয় কারণ তিনিই প্রথম কাল্পনিক মালমসলা বাদ দিয়ে বিশ্বের উৎপত্তি বিষয়ে পুরোপুরি প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা দেন। সামুদ্রিক বিভিন্ন প্রাণীর জীবাশ্ম আবিষ্কারের উপর ভিত্তি করে তিনি এ ধারণায় পৌঁছান যে সবকিছুর উৎপত্তি হয়েছে পানি থেকে। তিনি এবং তার উত্তরসূরিরা এশিয়া মাইনরের উপকূলে গ্রিকদের তুলনায় আরো অনেক উন্নত সভ্যতার জাতির মধ্যে বাস করতেন যেখানে অনেক ধরনের পৌরাণিক কল্পকাহিনী প্রচলিত ছিল, সন্দেহাতীতভাবে একারণেই তারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন বিশ্বের উৎপত্তি বিষয়ে অ-কাল্পনিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে। চেনা জগতকে পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে থেলিস ও তার অনুসারীরা যে পদ্ধতি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন তা স্বভাবতই গড়িয়েছিল সীমাবদ্ধ কিন্তু নিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে ব্যাপক সাধারণীকরণের প্রবণতায়।

থেলিসের শিষ্য এবং উত্তরসূরি আনাক্সিমান্দ্রোস (Anaximander, খ্রিস্টপূর্ব ৬১০–৫৪৬) চেষ্টা করেছিলেন মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে আরো বিশদ ব্যাখ্যা দিতে। তার মতে মহাবিশ্বের বিকাশ হয়েছে এমন কোন কিছু (apeiron) থেকে যা একই সাথে অসীম এবং অনির্দিষ্ট। এই অসীম ও অনির্দিষ্টতার মধ্য থেকে এমন কিছু একটা জাগ্রত হয়েছিল যা একই সাথে উত্তাপ ও শৈত্য উৎপন্ন করতে সক্ষম। একসময় এই দুই বিপরীতের সংঘর্ষ শুরু হয় এবং তা থেকে সৃষ্টি হয় মহাবিশ্বের। শৈত্যের কিছু অংশ শুকিয়ে হয়ে যায় কঠিন ভূপৃষ্ঠ, কিছু অংশ থেকে যায় পানি হিসেবে, আর কিছু অংশ উত্তাপের সাহায্যে বাষ্পীভূত হয়ে বাতাস এবং কুয়াশায় পরিণত হয়; বাষ্পীয়মান অংশটি উত্তাপকে অগ্নিময় বলয় হিসেবে আলাদা করে ফেলে যা সম্পূর্ণ মহাবিশ্বকে ঘিরে রেখেছে। যেহেতু এই বলয়গুলো কুয়াশা দিয়ে ঢাকা, শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু রন্ধ্র মানুষের চোখে সূর্য, চাঁদ এবং তারা হিশেবে দৃশ্যমান। আনাক্সিমান্দ্রোস সর্বপ্রথম বুঝতে পারেন ঊর্ধ্বমুখিতা এবং নিম্নমুখিতা পরম নয়, বরং নিম্নমুখিতা বলতে পৃথিবীর কেন্দ্রে যাওয়া এবং ঊর্ধ্বমুখিতা বলতে কেন্দ্র থেকে দূরে যাওয়া বোঝায়। ফলে ভূপৃষ্ঠকে ধরে রাখতে কোন অবলম্বন প্রয়োজন হয়না, ঠিক যেমনটি থেলিস মনে করতেন। থেলিসের পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে আনাক্সিমান্দ্রোস প্রাণের বিকাশের ধারণাটিকে আরো বিষদভাবে পুনর্গঠন করতে চাইলেন। তার মতে প্রাণ, আর্দ্রতার সাথে খুব ঘনিষ্ট সম্পর্কযুক্ত হওয়ায়, শুরু হয়েছিল সমুদ্রে। তাই তিনি মনে করতেন সকল ডাঙার প্রাণী এসেছে সামুদ্রিক প্রাণীদের থেকে। প্রথম মানবেরা শিশু অবস্থায় অভিভাবক ছাড়া টিকে থাকতে পারার কথা না, আনাক্সিমান্দ্রোস তাই মনে করতেন প্রথম মানবের জন্ম হয়েছিল অন্য কোন সামুদ্রিক প্রাণীর গর্ভে যেখানে তারা লালিত পালিত হয়েছিল নিজেরা টিকে থাকতে শেখার আগ পর্যন্ত। ক্রমান্বয়ে সকল আর্দ্রতা আংশিকভাবে বাষ্পীভূত হয়ে যাবে এবং অবশেষে সকল কিছু নির্বিশেষে সেই অসীম ও অনির্দিষ্টতায় (আপাইরন) গিয়ে মিশবে পারস্পরিক বিরোধের দণ্ড ভোগ করতে।

আনাক্সিমান্দ্রোসের উত্তরসূরি আনাক্সিমেনিস (Anaximenes, আ. খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৫) বলেছিলেন, বায়ু হচ্ছে সকল কিছুর উৎস। থেলিসের মত তিনিও বিশ্বের শুরুতে একটি বিশেষ পদার্থের অস্তিত্ব ধরে নিয়েছেন বলেই অনেককাল পর্যন্ত তার মতামতকে একপা পেছনে হাঁটা বলে মনে করা হতো। এসব সমালোচনা যে বিষয়টিকে এড়িয়ে গেছে তা হল, থেলিস বা আনাক্সিমান্দ্রোস এদের কেউই নির্দিষ্ট করে বলেননি কিভাবে পানি বা আপাইরন থেকে বাকি সবকিছুর উৎপত্তি হল, কিন্তু আনাক্সিমেনিস বলেছিলেন, ঘনীভবন (condensation) এবং লঘুভবন (rarefaction) প্রক্রিয়ায় বায়ু থেকে সকল কিছুর উদ্ভব। এদিক থেকে দেখলে বলতে হয়, থেলিস যাকে কেবল একটি সূচনা হিসেবে দেখেছিলেন, পরবর্তীতে তা একটি মৌলিক নীতিতে পরিণত হয়েছে যা সব রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গিয়েও মৌলিকভাবে প্রায় অপরিবর্তিত ছিল। ফলে ‘আর্কি’ (ἀρχή) শব্দটি প্রথমে যেখানে কেবল শুরু বা ‘প্রারম্ভ’ অর্থে ব্যবহৃত হতো, সেখানে পরবর্তীতে তার অর্থ হয়ে যায় ‘নীতি’—যে শব্দটি তখন থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত দর্শনের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। এই মূলনীতি, যা বিভিন্ন রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গিয়েও মূলগতভাবে চিরকাল অপরিবর্তনীয় থেকে গেছে, তা সত্যি ধরে নেয়ার মাধ্যমেই পরবর্তীতে এই ধারণার জন্ম হয়েছে যে, কোনকিছুই শূন্য থেকে আসতে পারে না এবং মানুষ যত উদয় ও বিলয় পর্যবেক্ষণ করে তার সবই আসলে একটি আবশ্যিকভাবে চির-অপরিবর্তনীয় জিনিসের রূপান্তর। পদার্থবিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের জন্য আবশ্যিক নিত্যতার সূত্রগুলোর—পদার্থ, বল, ও শক্তির নিত্যতা সূত্র—ভিত্তিও একে বলা যায়। আনাক্সিমেনিস তার ধারণার এত গভীর তাৎপর্য বুঝতে না পারলেও, আমাদের পক্ষে এর গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই।

প্রথম তিন গ্রিক দার্শনিককে বলা হয় হাইলোজোয়িস্ট (hylozoist), কারণ তারা সকলেই কোন একটি জীবন্ত পদার্থের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু এটা আসলে তাদেরকে বর্ণনা করার জন্য যথেষ্ট নয়। বরং তাদের সবচেয়ে অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হিসেবে বলা যায়, তারা বিভিন্ন ধরনের পদার্থ, বল ও গুণবৈশিষ্ট্যের মধ্যে—এমনকি ভৌত ও ভাবগত গুণবৈশিষ্ট্যের মধ্যেও—পরিস্কার কোন পার্থক্য দেখেননি। একই সত্তাকে কখনো ‘অগ্নি’ আবার কখনো ‘উত্তাপ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। উত্তাপকে কখনো বল আবার কখনো গুণবৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখানো হয়েছে, আবার ভৌত বৈশিষ্ট্য হিসেবে উষ্ণতা ও শৈত্যের সাথে প্রেমের উষ্ণতা ও ঘৃণার শৈত্যের কোন পার্থক্য করা হয়নি।

মহাকবি ও দার্শনিক যেনোফানিস (Xenophanes of Colophon, আ. খ্রিস্টপূর্ব ৫৬০–৪৭৮) প্রথম আনাক্সিমেনিসের দর্শনকে আরো পরিষ্কারভাবে ফুটিয়ে তোলেন। তিনি ঈশ্বর/দেবতাদের নিয়ে জনপ্রিয় ধারণাগুলোর সমালোচনা করে বলেছিলেন, মানুষ দেব-দেবীদের সৃষ্টি করেছে তাদের নিজেদের আদলে। তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল, তিনি বলেছিলেন বিশ্বজগতের নিয়ন্তা হিসেবে কেবলমাত্র একজন ঈশ্বর থাকতে পারেন, যিনি হবেন অবিনশ্বর। সকল সত্তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হওয়ায় তার পক্ষে অন্য কোন কম শক্তিশালী সত্তার মধ্য থেকে আসা সম্ভব ছিল না এবং তিনি অন্য কোন সত্তা দ্বারা অবদমিত হতে পারেন না, কারণ সর্বোচ্চ শক্তিশালীর চেয়ে বেশি শক্তিশালী কোন সত্তার জন্ম সম্ভব নয়। এই ধারণার জন্যও যে স্বতঃসিদ্ধটি ধরে নিতে হয় তা হল—শূন্য থেকে কোন কিছু আসতে পারে না এবং অস্তিত্বশীল কোন কিছু বিলীনও হয়ে যেতে পারে না।

এই স্বতঃসিদ্ধগুলোকে আরো সম্প্রসারিত করে সেগুলোকে তাদের যৌক্তিক উপসংহারের দিকে নিয়ে যান পার্মেনিদিস (Parmenides, জ. আ. খ্রিস্টপূর্ব ৫১৫), যিনি ‘এলেয়াবাদের’ (Eleaticism) ধারণার প্রতিষ্ঠাতা (এই মতের অধিকারীরা ভাবতেন গ্রহনযোগ্য বৈজ্ঞানিক ধারণা সেগুলোই যেখানে শুধুমাত্র যুক্তি দিয়ে পৌছানো যায়।) একটি দার্শনিক কবিতায় পার্মেনিদিস বলেছিলেন, যা আছে তার জন্ম ও মৃত্যু কোনটাই হতে পারে না, কারণ জন্ম হতে হলে তাকে যা নেই তা থেকে অর্থাৎ শূন্য থেকে আসতে হবে, এবং মৃত্যু হতে হলে তাকে শূন্যেই বিলীন হতে হবে, কিন্তু সেই শূন্য বা ‘যা নেই’ তার সংজ্ঞা অনুসারেই অস্তিত্বহীন। সুতরাং সবকিছু নিরেট, নিশ্চল, এক সত্তা। আমাদের পরিচিত বিশ্ব যেখানে উদয়, বিলয়, পরিবর্তন সব দেখা যায় তা কেবলই আমাদের বিশ্বাসের জগৎ (mere belief), রূপজগৎ। কবিতাটির দ্বিতীয় অংশে পার্মেনিদিস এই রূপজগতের একটি বিশ্লেষক বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করেন এবং দেখান যে এই জগৎ নির্ভর করে আমরা যাদেরকে সদর্থক (বাস্তব সত্তা থাকা, যেমন আলো ও উষ্ণতা) ও নঞর্থক (সদর্থক সত্তার অনুপস্থিতি, যেমন অন্ধকার ও শৈত্য) ভাবি তাদের পার্থক্যের উপর।

পার্মেনিদিসের দর্শনের একেবারে বিপরীত হিসেবে পরবর্তীতে দাঁড় করানো হয়েছিল হেরাক্লিতোসের (Heracleitus, আ. খ্রিস্টপূর্ব ৫৪০–৪৮০) দর্শনকে, কিন্তু লক্ষ্যণীয় যে পার্মেনিদিস যা দেখাতে চেয়েছিলেন, কিছু দিক দিয়ে হেরাক্লিতোস ঠিক সেটাই দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন: তিনি দেখিয়েছিলেন সদর্থক এবং নঞর্থক ব্যাপারগুলো আসলে একই জিনিসের দুইরকম পর্যবেক্ষণ; জীবন-মৃত্যু, দিন-রাত এবং আলো-আঁধার আসলে একই সত্তা।

বহুত্ববাদী বিশ্বতত্ত্বসমূহ

দর্শনের পরবর্তী বিকাশে পার্মেনিদিসের ধারণার প্রভাব ছিল অপরিসীম। পরবর্তী দুই প্রজন্মের দার্শনিকেরা তার ধারণার সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য চেষ্টা করে গেছেন, এম্পেদোক্লিস (Empedocles, আ. খ্রিস্টপূর্ব ৪৯০–৪৩০) ঘোষণা দেন যে সকল কিছুর মূলে রয়েছে চারটি মৌলিক উপাদান এবং ভালবাসা ও ঘৃণা এই দুটি শক্তি। মূল উপাদান চারটি প্রতিনিয়ত ভালবাসার দ্বারা একে অন্যের সাথে মিশ্রিত হতে এবং ঘৃণার দ্বারা আলাদা হতে থাকে। এই মিশ্রিত ও আলাদা হয়ে যাবার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যৌগিক বস্তুর উদ্ভব ও বিনাশ ঘটে। যেহেতু এম্পেদোক্লিস ভালবাসা ও ঘৃণাকে দুটি অন্ধ শক্তি হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন, ফলে তাকে ব্যাখ্যা করতে হয়েছিল কিভাবে দৈব গতিশীলতার মধ্য দিয়ে প্রাণের উদ্ভব ঘটতে পারে। যোগ্যতমের উদ্বর্তন (survival of the fittest) ধারণাটির স্থূল পূর্বানুমানের মাধ্যমে তিনি এই ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তার মতে, মিশ্রণ এবং পৃথক্-করণের মধ্য দিয়ে প্রাণীদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঘটনাচক্রে সৃষ্টি হয়ে যায়। কিন্তু এইসব প্রাণী শুধুমাত্র তখনই বেঁচে থাকতে পারবে যখন সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দৈব ঘটনাচক্রে এমনভাবে সৃষ্টি হবে যা সেই প্রাণীর টিকে থাকা ও প্রজনন করায় ব্যবহৃত হতে পারবে, আর এভাবেই নানারকম প্রজাতির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে।

বহুত্ববাদী দার্শনিক আনাক্সাগোরাস (Anaxagoras of Clazomenae, আ. খ্রিস্টপূর্ব ৫০০–৪২৮) মনে করতেন, যেহেতু কোনোকিছুর পরমজন্ম আসলেই হতে পারে না, সেহেতু সবকিছুর মধ্যেই সবকিছুকে থাকতে হবে, কিন্তু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিমাণে। শুরুতে এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাগুলো সমানভাবে পরস্পরের সাথে মিশ্রিত ছিল বলে কোনকিছুকে কোনকিছু থেকে আলাদা করা যেত না, অনেকটা আনাক্সিমান্দ্রোসের আপাইরনের মতো। এরপর একটি ‘মন’ বা ‘বুদ্ধিমত্তা’ (νοῦς) এই কণাগুলোর মধ্যে এমন একটি ঘূর্ণায়মান গতি সঞ্চার করে যে, তারা প্রথমে একে অন্যের থেকে আলাদা হয়ে যায়, এবং তারপর পুনর্মিলিত হয়ে বৈচিত্রময় সব মিশ্রণ তৈরি করে যা থেকে ক্রমান্বয়ে আমাদের বিশ্ব তৈরি হয়েছে। এম্পেদোক্লিসের অনুমিত শক্তিগুলোর মতো ‘মন’ কোন অন্ধশক্তি নয়, বরং সে সর্বদ্রষ্টা হিসেবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিশ্বের এবং সকল জীবন্ত ও বুদ্ধিমান সত্তার উদ্ভব ঘটিয়েছে। এই বৈপরীত্ব সত্ত্বেও উভয় মতবাদেই একটি মিল লক্ষ্য করা যায়। উভয় তত্ত্বেই ঘূর্ণায়মান গতির মাধ্যমে বিশ্বজগৎ তৈরি হওয়ার কথা বলা হয়েছে।

দর্শন ও ভৌত বিজ্ঞানের বিকাশে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হচ্ছে পরমাণুবাদী লেউকিপোস (Leucippus, জী. খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতক) এবং দিমোক্রিতোসের (Democritus, আ. খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০–৩৭০) পার্মেনিদিসের তত্ত্বের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা। লেউকিপোস সমাধান পান এই পূর্বানুমান থেকে যে শূন্যতাকে অস্তিস্ত্ববান বলা যায় এক উপায়ে—শূন্য ‘স্থান’ হিসেবে। তার মতে ভৌত বিশ্বের দুটি মৌলিক নীতি হল দু’ ধরনের স্থান—শূন্য স্থান ও পূর্ণ স্থান। পূর্ণ স্থান তৈরি হয় পরমাণু দিয়ে, তবে এ আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ‘পরমাণুর’ মতো বিভাজ্য নয়, বরং একেবারে অবিভাজ্য। লেউকিপোসের এ ধারণার উপর ভিত্তি করে দিমোক্রিতোস পারমাণবিক গঠন বিশ্লেষণ করে দৃশ্যমান পৃথিবীর নানাবিধ ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার জন্য একটা সম্পূর্ণ পদ্ধতি দাঁড় করান। এ পদ্ধতির শুরু কিছু মৌলিক ভৌত সমস্যা থেকে, যেমন: একটি শক্ত বস্তু কিভাবে একটি নরম বস্তু থেকে হালকা হতে পারে। এর ব্যাখ্যা হচ্ছে, ভারী বস্তুতে অনেক সংখ্যক পরমাণু থাকে যারা গোলাকৃতি এবং সমভাবে বন্টিত, কিন্তু হালকা বস্তুতে অল্পসংখ্যক পরমাণু থাকে যাদের আবার হুক আছে, যেগুলো দিয়ে তারা ঝাঁঝরির মতো কাঠামো তৈরি করে। এ মতবাদ অনুযায়ী, একজন সুস্থ ও হাসিখুশি মানুষ আক্ষরিক অর্থেই ভালভাবে ‘নির্মিত’। যদিও বিধ্বংসী আবেগের সাথে জড়িত থাকে হিংস্র ও দূরবর্তী পারমানবিক গতি, শিক্ষা সেগুলোকে নিয়ন্ত্রন করে উন্নততর গঠন নিশ্চিত করতে পারে। এছাড়াও দিমোক্রিতোস সংস্কৃতির বিবর্তন নিয়ে একটি তত্ত্ব প্রণয়ন করেন যা পরবর্তী চিন্তাবিদদেরকে প্রভাবিত করেছিল। তার মতে, সভ্যতার উদ্ভব হয় জীবনের প্রয়োজন থেকে, যা মানুষকে বাধ্য করে কাজ ও উদ্ভাবন করতে। যখন জীবনযাপন খুব সহজ হয়ে যায় এবং সকল প্রয়োজন মিটে যায় তখনই সেটা সভ্যতার জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়, তখন মানুষ উচ্ছৃঙ্খল ও অসাবধান হয়ে পড়ায় সভ্যতার পতন হতে থাকে।

বাহ্যরূপের জ্ঞানতত্ত্ব

পার্মেনিদিস-পরবর্তী সময়ের দার্শনিকরা পার্মেনিদিসের মতোই ধরে নিয়েছিলেন যে প্রকৃত বিশ্ব আমাদের প্রত্যক্ষীকৃত বিশ্বের চেয়ে আলাদা। আনাক্সাগোরাস বলতেন, সবকিছুর মধ্যে সবকিছুর অংশ বিদ্যমান, কিন্তু তা মানুষের ইন্দ্রিয়গোচর হয় না। তিনি দাবি করেছিলেন, যদি কোন একটি বস্তুতে কোন একটি নির্দিষ্ট কণা অন্য কণাগুলোর তুলনায় খুব বেশি মাত্রায় থাকে তাহলে পরিমাণে কম থাকা কণাগুলো ইন্দ্রিয়গোচরই হবে না। তিনি আরো পর্যবেক্ষণ করেন, কখনো কখনো বিভিন্ন মানুষ এবং বিভিন্ন প্রাণী একই জিনিস ভিন্নভাবে প্রত্যক্ষ করে। এই ঘটনা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, সমধর্মী উপাদানগুলো একে অপরকে অনুভব করতে পারে। যেমন, কারো ইন্দ্রিয়তে যদি কোন উপাদানের মাত্রা কম থাকে তাহলে সে ঐ ধরনের উপাদানের উপস্থিতি কম অনুভব করতে পারবে। কেন কিছু প্রাণী রাতে ভাল দেখতে পায় বা আর কিছু দিনে, সে বিষয়টিও ব্যাখ্যা করা হয়েছিল এই যুক্তিতে। দিমোক্রিতোসের মতে পরমাণুর স্বাদ, গন্ধ, রঙ বা এ ধরণের কোন ইন্দ্রিয়জাত বৈশিষ্ট্য নেই। পরমাণুগুলোকে স্পর্শনীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ধরে নিয়ে তার ভিত্তিতে তিনি বস্তুর পারমাণবিক গঠন বিষয়টি বিশদ ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলেন, যেমন চোখে ধারালো পরমাণুর সূচের মতো আঘাত করাকে তিনি উজ্জ্বল সাদা আলোর ব্যাখ্যা বলে দাবি করেছিলেন।

জ্ঞানতত্ত্বের ইতিহাসে আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন পার্মেনিদিসের তরুণ বন্ধু এলেয়া’র জিনো (Zeno of Elea, আ. খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৫–৪৩০)। বহুত্ববাদ অস্বীকার করে এবং নিশ্চল, একক ও নিরেট সত্তার অদ্ভুত তত্ত্ব দিয়ে পার্মেনিদিস অনেক সমালোচিত হয়েছিলেন, তখন তার সমর্থনে এগিয়ে এসে জিনো গতি ও বহুত্ববাদের পূর্বানুমান থেকে আসা অন্য তত্ত্বগুলোর অসঙ্গতি আলোচনা করেন। তিনি তার দর্শন ব্যক্ত করছেন বেশ কিছু প্রহেলিকার মাধ্যমে: একটি উড়ন্ত তীর নিশ্চল কারণ এটি যে-স্থানে অবস্থান করছে বা যে-স্থানে অবস্থান করছে না এ দুই ক্ষেত্রেই স্থান পরিবর্তনে অক্ষম, একিলিস অনেক বেশি বেগবান হওয়া সত্ত্বেও কচ্ছপকে কখনোই অতিক্রম করতে পারবে না ইত্যাদি। জিনোর প্রহেলিকাগুলো অধিকাংশ সময়ে নিরর্থক যুক্তি হিসেবে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে, তবে এই ধাঁধাঁর গাণিতিক সমাধানের জন্যও অনেক চেষ্টা করা হয়েছে যার ফল হিসেবেই অভিসারী ধারা’র (convergent seris) তত্ত্ব ও সেট তত্ত্বের জন্ম হয়েছে।

সংখ্যার অধিবিদ্যা

এতক্ষণ পর্যন্ত যেসব দর্শনের কথা বলা হয়েছে সেগুলো কোন না কোনভাবে একে অপরের নিকটবর্তী। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকের শেষের দিকে একটি অনেক স্বতন্ত্র দর্শনের জন্ম হয়, পিথাগোরাসের (Pythagoras, আ. খ্রিস্টপূর্ব ৫৮০–৫০০) দর্শন। পিথাগোরাস মধ্যপ্রাচ্য ও মিশরে দীর্ঘভ্রমণের পর জন্মস্থান সামোসে ফিরে আসেন, কিন্তু পরে শাসক পলিক্রাতিসের (Polycrates, আ. খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৫–৫২২) স্বৈরশাসন থেকে বাঁচতে দক্ষিণ ইতালি চলে যান। সেখানে ক্রোতোন (Croton) ও মেতাপন্তিয়নে (Metapontum) তিনি কঠোর নিয়মতান্ত্রিক একটি দার্শনিক সংগঠন তৈরি করেন যার মাধ্যমে খুব দ্রুত রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক প্রভাবশালী হয়ে যান। তিনি মধ্যপ্রাচ্য থেকে আত্মার দেহান্তর/পুনর্জন্ম সংক্রান্ত একটি মতবাদ (transmigration of souls) নিয়ে আসেন। তবে বিজ্ঞান ও দর্শনের ক্ষেত্রে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ হচ্ছে: ‘সকল বস্তুই আসলে সংখ্যা’, অর্থাৎ সকল কিছুর অস্তিত্ব এবং গঠন ব্যাখ্যা করা যায় তাদের মধ্যকার সংখ্যাগত সম্পর্ক থেকে। আসলে এটাও ছিল অল্প কিছু পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে মোটাদাগে সাধারণীকরণ, যেমন একই সংখ্যাগত অনুপাত ব্যবহার করে সেতার, বাঁশি, চাকতি ইত্যাদি বিভিন্ন যন্ত্র থেকে একই ধরনের সুরেলা ধ্বনি (harmonies) সৃষ্টি করা সম্ভব, নক্ষত্রগুলোর চলনের মধ্যে কিছু নিয়মতান্ত্রিকতা বিদ্যমান, ত্রিভূজের আকৃতি নিরূপণ করা যায় তার বাহুগুলোর দৈর্ঘের অনুপাতের ভিত্তিতে। পিথাগোরাসের অনুসারীরা সকল ক্ষেত্রে এই নীতি ব্যবহার করার চেষ্টা করতেন, তারই ফলশ্রুতিতে হিপাসোস (Hippasus of Metapontum, জী. খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতক) সমগ্র বিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম মৌলিক আবিস্কারটি করেন: বর্গ এবং স্বাভাবিক পঞ্চভুজের বাহু এবং কর্ণের দৈর্ঘ্য অসমগুণনীয়ক (incommensurable), অর্থাৎ তাদের আনুপাতিক সম্পর্ককে পূর্ণ সংখ্যার ভগ্নাংশ দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। শুরুতে এই তত্ত্ব পিথাগোরীয় দর্শনের ভিতকে নাড়া দেয়, ফলে এর অনুসারীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক অংশ মেতে থাকে দুর্বোধ্য গাণিতিক অনুমানযজ্ঞে এবং আরেক অংশ আগায় অসাধারণ গাণিতিক উদ্ভাবনের পথে। পিথাগোরীয় দর্শন পরবর্তীতে প্লেটোর চিন্তা-ভাবনাতেও ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

এখন পর্যন্ত বর্ণিত অনুমিতিগুলো অনেক দিক থেকেই গ্রিক দর্শনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, কারণ এখানে প্রথমবারের মতো পাশ্চাত্য দর্শনের অনেক মৌলিক বিষয় আলোচনায় আসে। বর্তমান যুগ পর্যন্ত পাশ্চাত্য দর্শন ও বিজ্ঞানের অনেক ক্ষেত্রে এসব ধারণার ব্যপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

নৃতত্ত্ব এবং অপেক্ষবাদ

খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকে গ্রিক চিন্তাধারা এক নতুন মোড় নেয় ‘সফিস্ট’দের (Sophist) আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে। এ নামটির উদ্ভব sophizesthai ক্রিয়াপদ থেকে যার অর্থ হতে পারে ‘চাতুর্য ও উদ্ভাবনী শক্তিকে পেশায় পরিণত করা’, যা সফিস্টদের জন্য যথাযোগ্য নাম। কারণ তারা শিক্ষাদানের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করত। পূর্বের অধিকাংশ দার্শনিক মতবাদ যেখানে ধরে নিয়েছিল সত্যিকারের জগৎ আসলে আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পৃথিবীর থেকে আলাদা, সেখানে তারা প্রচলিত মতবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে প্রশ্ন করতেন এই ধরনের পূর্বানুমানের যথার্থতা কী যেখানে কেউই আসলে তথাকথিত ‘সত্যিকারের দুনিয়া’য় বাস করে না। প্রোতাগোরাসের (Protagoras of Abdera, আ. খ্রিস্টপূর্ব ৪৯০–৪২০) দৃঢ় মতামত ছিল, “মানুষই সবকিছুর মাপকাঠি, সে যা তার এবং যা নয় তারও।” মানুষের জন্য ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পৃথিবীটাই তার সত্যিকারের জগৎ, অন্য কোন কিছু নয়। প্রোতাগোরাস উদাহরণ দিয়ে বলেন, ঠাণ্ডায় কম্পমান কোন মানুষকে এটা বলা অর্থহীন যে আসলে এখন গরম পড়ছে, কারণ তার অনুভবে এখন ঠাণ্ডা অস্তিত্ববান। তার সমসাময়িক তরুণ দার্শনিক (বাগ্মিতার নৈপুণ্য নিয়ে নিবন্ধের জন্য বিখ্যাত) গোর্গিয়াস (Gorgias, জী. খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতক) Peritoumēontos ē periphyseōs (“যা নয় তা সম্পর্কে; বা প্রকৃতি সম্পর্কে”) গ্রন্থে অন্য দার্শনিকদের উপহাস করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন: (১) কোনকিছুরই অস্তিত্ব নেই, (২) যদি কোনকিছুর অস্তিত্ব থেকেও থাকে, সেটা জানা কারো পক্ষে সম্ভব না, এবং (৩) যদি আসলেই কেউ কোনকিছুর অস্তিত্বের কথা জেনে থাকে, সে কখনোই তার সেই জ্ঞান অন্য কাউকে জানাতে পারবে না। পার্মেনিদিসের একক, অপরিবর্তনীয় ও নিশ্চল সত্ত্বার ধারণার বিরুদ্ধে গিয়েই যেন গোর্গিয়াস প্রমাণ করতে চাইলেন একক, অপরিবর্তনীয় ও নিশ্চল সত্ত্বার ধারণা প্রমাণ করা যত সহজ, ততই সহজ সবকিছুকে অস্তিত্বহীন প্রমাণ করা।

সফিস্টরা শুধু প্রচলিত দার্শনিক মতবাদই নয়, অন্য অনেক প্রথা সম্পর্কেও সংশয়ী ছিলেন। বিভিন্ন জাতি নারী-পুরুষের সম্পর্ক, বিয়ে, মৃতদেহের সৎকার ইত্যাদির মত পবিত্র বিষয়গুলোর ক্ষেত্রেও একেক রকম রীতি মেনে চলে এটা পর্যবেক্ষণ করে তারা এ সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে অধিকাংশ নিয়মই মূলত লোকাচার। জীবনে সফল হওয়া ও অন্যদের উপর প্রভাব বিস্তার করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে সফিস্টরা প্রচার করতেন। গোর্গিয়াস নিজে চিকিৎসক না হয়েও একজন রোগীকে একটা জরুরি অস্ত্রোপচার করতে সহজে রাজি করিয়ে ফেলেছিলেন যা তার ভাই চিকিৎসক হয়েও করতে পারেননি, এ ঘটনাটি নিয়ে তিনি খুব গর্ববোধ করতেন। প্রথম দিকে সফিস্টরা নীতিবর্জিত শিক্ষা দিতেন না, তারপরেও তারা সন্দেহের আওতায় আসেন ধূর্ততার সাথে তর্ক করার স্বভাব ও ক্ষমতার জন্য। পরের দিকে একজন সফিস্ট থ্রাসিমাকোস (Thrasymachus of Chalcedon, জী. খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতক) তো দম্ভভরে বলেই ফেলেছিলেন, অপেক্ষাকৃত সবল বা উন্নততর মানুষ (যে অন্যদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে) নিজের জন্য যা কল্যাণকর মনে করে তাই সঠিক।

গ্রিক দর্শনের যুগান্তকারী চিন্তাবিদগণ

সক্রেটিস

সক্রেটিসকে (খ্রিস্টপূর্ব ৪৭০–৩৯৯) সফিস্টদের একজন বলেই ধরা হতো যদিও তিনি অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা দিতেন না, অন্যান্য সফিস্টদের থেকে তার লক্ষ্যও আলাদা ছিল। ‘দার্শনিক’ শব্দটির প্রবর্তক পিথাগোরাস হলেও এ শব্দটির বহুল ব্যবহার শুরু হয় সক্রেটিসের মধ্য দিয়েই, যিনি বলতেন তার কোন প্রজ্ঞা নেই, বরং তিনি প্রজ্ঞার অনুসন্ধানে নিয়োজিত। সক্রেটিসের শিষ্য ও অনুসারীদের কাছ থেকে জানা যায়, সক্রেটিস কখনোই সরাসরি কাউকে কিছু শেখাতেন না। বরং তিনি তরুণ-বৃদ্ধ, উচ্চ-নিম্ন সকল শ্রেণীর মানুষের সাথে আলাপে মত্ত হয়ে যুক্তি দিয়ে তাদের মতামত ও চিন্তার অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করতেন। দুটি দৃঢ় নীতির উপর তার জীবনদর্শন প্রতিষ্ঠিত, (১) প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনভাবেই খারাপ কিছু না করা এবং (২) ভালমন্দের চেতনাহীন ব্যক্তিই কেবল এ নীতির বিপক্ষে কাজ করতে পারে। প্রথম নীতিটির অনুসরণ তিনি অনেক ক্ষেত্রেই করে দেখিয়েছেন। যেমন আর্গিনুসে যুদ্ধের (Arginusae, খ্রিস্টপূর্ব ৪০৬) পর এথেনীয় পরিষদের অধিকাংশ সদস্য চাচ্ছিলেন বিনা বিচারে নৌসেনাপতিদের মৃত্যদণ্ড দিতে। কিন্তু সেই পরিষদের সভাপতি সক্রেটিস (প্রতিদিন এ সভার সভাপতি বদল হতো) সে প্রস্তাবকে ভোটের জন্য বিবেচনা করেন নি, এমনকি নানা হুমকি অগ্রাহ্য করেও।

খ্রিস্টপূর্ব ৪০৪ সালে যখন এথেন্সের গণতন্ত্র উৎখাত করে তথাকথিত “ত্রিশ স্বৈরাচারের” শাসন কায়েম হয়, যারা প্রত্যেককে তাদের অনাচারের অংশ করে নিতে চেয়েছিল এবং যেকোন নির্দোষ নাগরিককে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়ে রেখেছিল, তখনো সক্রেটিস তাদেরকে অমান্য করেন, যা ছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সার্বভৌম জনগণের ইচ্ছাকে অমান্য করার চেয়েও বেশি বিপজ্জনক। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চলাকালীন সময়েও তিনি বলতেন একজন রাষ্ট্রনায়কের রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্যতা বিবেচনায় না এনে তার বাকপটুতায় প্রভাবিত হয়ে যাওয়াটা কতটা অযৌক্তিক যেখানে একজন বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিক কখনোই হাতুড়ের কাছ থেকে সমাধান নেয় না, বরং সবচেয়ে ভাল চিকিৎসককে খুঁজে বের করে। সবচেয়ে মৌলিক যে অসঙ্গতি সক্রেটিস দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন তা হল মানুষ অন্যের মাঝে যে ব্যাপারগুলো ভাল বলে বিবেচনা করে (যেমন নিজের ক্ষতি করেও অন্যার উপকার করা) তা তারা নিজেদের জন্য ভাল মনে করে না, আর নিজেদের জন্য যেটাকে ভাল মনে করে তা অন্যের মধ্যে দেখলে তারা ঘৃণা করে। তার এসব চিন্তাপদ্ধতি ও নীতির প্রচারের ফলে একদিকে তিনি তরুণদের মাঝে তুমুল জনপ্রিয় হন, অন্যদিকে রাজনীতিকদের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়ান। ত্রিশ স্বৈরাচারের শাসনামল অনেক ছোট ছিল, এবং তাদের অনেক ঘনিষ্ট আত্মীয় সক্রেটিসের অনুসারী ছিলেন বলে সে সময়ে সক্রেটিস তাদের রোষানল থেকে বেঁচে যান। কিন্তু পরবর্তীতে এথেন্সের গণতন্ত্রের পুনঃস্থাপনের পর তিনি নীতিভ্রষ্টতা ও তরুণদের বিপথগামী করার অভিযোগে অভিযুক্ত হন এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন, মূলত নৌসেনাপতিদের বিচারের সময় গণমতের বিরুদ্ধে আপোসহীন অবস্থান নেয়ার ফলাফল হিসেবে।

সক্রেটিসের মৃত্যুর পর গ্রিক ও রোমান দর্শনের প্রাচীন অধ্যায়ে তার দর্শন বিশাল প্রভাবশালী হয়ে ওঠে যা আজো বিদ্যমান। দার্শনিক প্লেটো, ঐতিহাসিক যেনোফন (Xenophon, খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১–আ. ৩৫০) তার দার্শনিক চিন্তাপদ্ধতিকে লিখে সংরক্ষণ করেন। মেগারা’র ইউক্লিড (Euclid of Megara, খ্রিস্টপূর্ব আ. ৪৩০–আ. ৩৬০) সক্রেটিসের ভাবনার তাত্ত্বিক দিকগুলোর উপর গুরুত্ব দেন, আর আন্তিস্থেনিস (Antisthenes, খ্রিস্টপূর্ব আ. ৪৪৫–আ. ৩৬৫) একজন খাঁটি দার্শনিকের জাগতিক অভাব থেকে মুক্ত থাকার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব দেন। আন্তিস্থেনিস তার শিষ্য দিয়োগেনিসের (Diogenes of Sinope, মৃ. খ্রিস্টপূর্ব ৩২০) মাধ্যমে ‘সিনিক’ (Cynic) দলের উদ্ভব ঘটান—দিয়োগেনিস স্বেচ্ছাদারিদ্রকে চরম পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং সকল প্রচলিত রীতিনীতির বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়াকে গুরুত্ব দিতেন। ‘কিরেনায়িক’ (Cyrenaic) দলের প্রতিষ্ঠাতা আরিস্তাপোস (Aristippus of Cyrene, খ্রিস্টপূর্ব আ. ৪৩৫–৩৬৬) সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে জাগতিক মোহমুক্তিকে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে একজন দার্শনিকের জাগতিক ব্যাপারগুলো উপভোগ করতে বাধা নেই যদি সে বিষয়গুলোর অভাব তাকে বিচলিত না করে। আরিস্তাপোস যদিও তার ছেলেকে ত্যাজ্য করেছিলেন উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের জন্য, কিন্তু তিনি তার মেয়ে ও নাতির মাধ্যমে যে মতবাদের প্রতিষ্ঠা করেছেন তা ছিল সুখবাদী (hedonistic), এ মতবাদ অনুযায়ী সুখ হচ্ছে সর্বোত্তম ও সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

প্লেটো

সক্রেটিসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিষ্য প্লেটো (খ্রিস্টপূর্ব ৪২৭–৩৪৭) ছিলেন অভিজাত বংশের সন্তান, তার পূর্বপুরুষগণের মধ্যে ছিলেন এথেন্সের শেষ রাজা এবং সোলন (Solon, আ. খ্রিস্টপূর্ব ৬৩০–৫৬০), বিশিষ্ট সমাজ ও রাজনৈতিক সংস্কারক। সক্রেটিস সাধারণ বংশোদ্ভূত হওয়ার পরও তরুণ প্লেটো ছিলেন তার একাগ্র অনুসারী। তবে প্লেটো সক্রেটিসের মতো ব্যক্তিবিশেষের আচরণ নিয়ে খুব বেশি ভাবতেন না, বরং তিনি রাজনৈতিক সংগঠনকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। তরুণ বয়সে প্লেটো দেখেছেন উচ্চাভিলাষী রাজনীতিবিদদের কথায় প্রলুব্ধ হয়ে এথেন্সের লোকজনকে দলে দলে যুদ্ধে গিয়েও শেষমেষ পেলোপনেসিয়া’র যুদ্ধে পরাজিত হতে। গণতন্ত্রের পতনের পর ‘ত্রিশ স্বৈরাচারের’ শাসনব্যবস্থা নিয়ে তিনি ব্যাপক আশাবাদী ছিলেন, মূলত হয়ত তাদের নেতা ক্রিতিয়াস (Critias) প্লেটোর ঘনিষ্ট স্বজন ছিলেন বলে। কিন্তু তিনি দেখলেন গণতন্ত্র নতুন এ স্বৈরাচারী ব্যবস্থার চেয়ে অনেক শ্রেষ্ঠতর ছিল। পরবর্তীতে খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৯ সালে গণতন্ত্রের পুনঃস্থাপনার পর যখন হঠকারী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ হিসেবে একটি লিখিত আইন করা হল তখন প্লেটো আবার আশাবাদী হলেন, এমনকি তিনি সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ডকেও নতুন শাসনব্যবস্থার যৌক্তিক পরিণাম নয় বরং একটা অযাচিত ভুল হিসেবে মেনে নিতে রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু কয়েক বছর পরেই গণমতের উৎপাত আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলে তিনি হতাশ হয়ে বলেন, পরিস্থিতির উন্নতি কখনোই হবে না যদি না দার্শনিকরা শাসক অথবা শাসকরা দার্শনিক না হন। তিনি রাজনৈতিক বাগ্মিতা ও প্রপাগান্ডার তীব্র সমালোচনা করে গোর্গিয়াস নামে একটি সংলাপ লেখেন।

পরবর্তীতে তিনি দক্ষিণ ইতালি’র সিরাকুজায় যান সেখানকার রাজনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করার জন্য। কিন্তু সেখানে এথেন্সের গণতন্ত্রের চেয়েও খারাপ ধনিকতন্ত্রের সাথে পরিচিত হন। তবে সিরাকুজায় তিনি দিয়োন (Dion, খ্রিস্টপূর্ব আ. ৪০৮–৩৫৪) এবং দিয়োনিসোস-প্রথমের (Dionysius, খ্রিস্টপূর্ব আ. ৪৩০–৩৬৭) সাথে পরিচিত হন যারা তার রাজনৈতিক ধ্যানধারণা ও দর্শনে ব্যাপক আগ্রহী হন এবং সুযোগ পেলে তার সাথে কাজ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এথেন্সে ফিরে প্লেটো দার্শনিকদের শিক্ষার জন্য একটি একাডেমি স্থাপন করেন এবং পরবর্তী বছরগুলোতে অনেকগুলো সংলাপ রচনা করেন যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে রিপাবলিক, যেখানে প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রের খসড়া দেখিয়েছেন। প্লেটোর মতে মানুষের আসক্তি ও অভিলাষই সমাজে সকল অনর্থের মূল, সুতরাং আদর্শ রাষ্ট্র পরিচালিত হওয়া উচিত একজন অভিজাতের মাধ্যমে যিনি শুধুমাত্র যুক্তি দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন এবং তার অনুগত একদল যোদ্ধা নিয়োজিত থাকবে। শাসক কোন ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিক হতে পারবেন না বা সংসারী জীবনযাপন করতে পারবেন না। কর্মরত জনগণ (যারা ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিক হতে পারবেন) শাসকের প্রয়োজনীয় জিনিসের যোগান দেবেন। সেই রাষ্ট্রনায়ককে বিশেষভাবে শিক্ষা দিয়ে একাজের জন্য প্রস্তুত করা হবে। দিয়োনিসোস-প্রথমের মৃত্যুর পর দিয়োন প্লেটোকে আবার সিরাকুজায় আমন্ত্রণ জানান যাতে দিয়োনিসোস-প্রথমের উত্তরসূরি দিয়োনিসোস-২য় প্লেটোর মতধারা অনুসরণ করে শাসক পদ থেকে সরে আসেন। কিন্তু তাদের এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। স্টেটসম্যান এবং ল’স গ্রন্থে প্লেটো দেখানোর চেষ্টা করেন, একমাত্র ঈশ্বরই তার কল্পিত দার্শনিক-শাসিত রাষ্ট্রে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে। তিনি মনে করতেন মানব-শাসকদেরকে কঠোর আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত, যদিও সকল আইন অনিবার্যভাবে ত্রুটিপূর্ণ, যেহেতু জীবন কিছু বাধাধরা নিয়মের মাধ্যমে পরিচালিক হওয়ার পক্ষে বড্ড বৈচিত্রময়।

তাত্ত্বিক দর্শনে প্লেটোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে ‘স্বরূপের’ (Form) তত্ত্ব যার উদ্ভাবন তিনি সক্রেটিসের পদ্ধতি অনুসরণ করে করেছিলেন। সক্রেটিস যেমন আলোচনার মাধ্যমে মানুষের ভাবনা ও কাজের অসঙ্গতিগুলো তুলে আনার সময় প্রশ্ন করতেন, একজন মানুষ কোন কিছুকে ভাল, মন্দ, সাহসী, ধার্মিক ইত্যাদি বলতে ঠিক কী বুঝাচ্ছে, এবং তা বলার সময় ঠিক কোন জিনিসটাকে দেখছে। তেমনি প্লেটো তার সংলাপে অনেক সময় সক্রেটিসের মুখ দিয়ে প্রশ্ন করাতেন, একজন মানুষ যখন কোনকিছুকে ‘ভাল’ বলছে তখন তার মাথায় ঠিক কোন ভাবটির (আইডিয়া: ιδέα) উদয় ঘটছে, বা ঠিক কোন চিত্রটি ফুটে উঠছে। এ প্রশ্নের সরাসরি কোন উত্তর দেয়া হতো না, কারণ কোন বিমূর্ত ধারণার মাধ্যমেই বিষয়টি পুরোপুরি বুঝানো সম্ভব নয়, আর নির্দিষ্ট কোন উত্তর দেয়াও এ প্রশ্নের লক্ষ্য নয়, বরং কিছু একটা অব্যাখ্যেয় আইডিয়া মাথায় রেখেই যে মানুষ কোন কিছুকে ভাল, মন্দ বা নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করে তা তুলে ধরাই এখানে মূল উদ্দেশ্য। শুরুতে যা ছিল অব্যাখ্যেয় কোন কিছুকে প্রকাশ করার প্রচেষ্টা সেটাই পরবর্তীতে স্বরূপের তত্ত্ব হিসেবে পরিচিত হল যখন প্লেটো আবিস্কার করলেন যে গণিতেও এ ব্যাপারটি প্রত্যক্ষ করা যায়। দৃশ্যমান পৃথিবীতে কোন কিছুই একে অপরের পুরোপুরি সমান নয়, বা কোন কিছুই নিখাদ ভাল বা সুন্দর নয়, তারপরেও একাধিক জিনিসের মধ্যে সমতা শুধুমাত্র গণিতই নয় বরং প্রাত্যহিক জীবনেরও অন্যতম মৌলিক ধারণা—সব পরিমাপের ভিত্তিই হচ্ছে সমতা। সুতরাং, শুভ ও সুন্দরের মতো এটিও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় এমন কোন এক বাইরের জগৎ থেকে আসা, প্লেটো যে জগতের নাম দিয়েছিলেন স্বরূপজগৎ (the world of Forms)। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিশ্বের বাইরে কোন জগতের অস্তিত্বের ইঙ্গিত পাওয়া যায় এই ব্যাপারটিতে যে—মানুষ সবসময় ত্রুটিপূর্ণ জিনিসের চেয়ে নিখুঁত জিনিসকে বেশি প্রাধান্য দেয়, যেমন অগঠিতের উপর সুগঠিত বস্তু, মিথ্যার উপরে সত্য, হেত্বাভাসের উপর যৌক্তিক সিদ্ধান্ত, উদ্ভট উপস্থাপনার উপর যৌক্তিক বৈজ্ঞানিক উপস্থাপনকে স্থান দেয়া হয়।

প্লেটোর মতে মানুষের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সকল কিছু সেগুলোর চিরন্তন স্বরূপের ক্রুটিপূর্ণ প্রতিরূপ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক স্বরূপ হচ্ছে ‘শুভ’। এটি “সকল সত্তা ও জ্ঞানের বাইরে”, তারপরও এটি উভয়েরই ভিত্তি। ‘সত্তা’ বলতে এখানে অস্তিত্ব বুঝাচ্ছে না, বরং সুনির্দিষ্ট কিছু বুঝাচ্ছে, যেমন একজন মানুষ, একটি সিংহ বা একটি বাড়ি—যাকে এর গুণ ও আকৃতি দিয়ে আলাদা করা যায়। জ্ঞানের শুরু হয় এইসব জাগতিক আকৃতি থেকে কিন্তু এটি মূলত আসে উচ্চতর কোন স্বরূপজগৎ থেকে যার সাথে মানবমনের যোগাযোগ আছে।  গুহার রূপক নামে খ্যাত একটি কাহিনীর সাহায্যে প্লেটো ব্যাখ্যা করেন: একটি অন্ধকার গুহায় বসে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকা একজন মানুষ কেবলমাত্র তার পিছনের বাস্তব জিনিসগুলোর ছায়াই দেখতে পায়, কিন্তু সে যখন গুহার বাইরে বেরিয়ে আসে এবং বাস্তব জগৎকে দেখে তখন সে জানতে পারে বাস্তব কোনটি। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতে যা দেখা যায় তা ইন্দ্রিয়ের বাইরের আসল জগতের ছায়ামাত্র।

তার পরবর্তী সংলাপগুলোতে বিশেষ করে Theaetetus-এ প্লেটো জ্ঞানের অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্বের সমালোচনা করেন, পরবর্তীতে ১৭ শতকে টমাস হবসের (Thomas Hobbes, ১৫৮৮–১৬৭৯) মতো ইংরেজ দার্শনিকরা একই কাজ করেছিলেন। Timaeus সংলাপে প্লেটো পিথাগোরাসের কিছু ধারণা ব্যবহার করে পদার্থবিদ্যার একটি সামগ্রিক পদ্ধতি তৈরির করার চেষ্টা করেন।

এরিস্টটল

প্লেটোর মৃত্যুর পর তার একাডেমি অনেক শতক ধরে বিভিন্ন মানুষের পরিচালনায় পরিচালিত হয়। প্লেটোর ভাগ্নে স্পেউসিপোস (Speusippus, মৃ. আ. খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৮) উত্তরাধিকারী হিসেবে একাডেমির পরিচালনার ভার পাবার পরপর প্লেটোর শ্রেষ্ঠতম শিষ্য এরিস্টটল মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে আনাতোলিয়ার Assus এবং পরবর্তীতে লেসবস দ্বীপে চলে যান। কিন্তু শীঘ্রই তিনি মেসিডোনীয় রাজপরিবারে যুবরাজের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন, এই যুবরাজই হলেন মহামতি আলেকজান্ডার (Alexander, খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৬–৩২৩)। আলেকজান্ডার সম্রাট হবার পর এরিস্টটল এথেন্সে ফিরে আসেন এবং তার নিজস্ব একাডেমি ‘লাইসিয়াম’ (Lyceum) প্রতিষ্ঠা করেন, যার সদস্যদেরকে ‘Peripatetics’ বলা হতো। পায়চারি করে শিক্ষাদানের পদ্ধতির কারণেই সম্ভবত এ নামের উদ্ভব।

১৭ বছর বয়সে এরিস্টটল প্লেটোর একাডেমির সদস্য হন—যখন প্লেটো সিসিলিতে ছিলেন এবং একাডেমির ভারপ্রাপ্ত প্রধান ছিলেন Eudoxus—, কিন্তু ধীরে ধীরে প্লেটোর মতবাদের সাথে তার মতবাদের বিভেদ বাড়তে থাকে। প্লেটোর স্বরূপতত্ত্ব নিয়ে আপত্তি তোলেন এরিস্টটল, আর একাডেমিতে থাকাকালীন তিনি বিভিন্ন সক্রেটিক আলোচনার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করা শুরু করেন, যা পরবর্তীতে যুক্তিবিদ্যার উপর তার কাজগুলোকে রূপ দেয়। এরিস্টটল যথার্থভাবেই যুক্তিবিদ্যার জনক হিসেবে নিজেকে দাবি করতেন, এবং আসলে এই কিছুকাল আগ পর্যন্তও ধারণা করা হতো এরিস্টটল যুক্তিবিদ্যা সম্পর্কে যা বলে গেছেন তার সাথে যোগ করার আর কিছুই নেই।

নিজের একাডেমি লাইসিয়াম প্রতিষ্ঠা করার বেশ আগেই এরিস্টটল এ মতবাদ দিয়েছিলেন যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের বাইরের কোন উৎকৃষ্ট জগতের অস্তিত্ব কল্পনা করার দরকার নেই, বরং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎই আসল জগৎ এবং একটি নির্দিষ্ট ধরনের জিনিস সম্পর্কে কোন জ্ঞানপদ্ধতি দাঁড় করাবার জন্য সেই জিনিসগুলো সম্পর্কে সাধারণভাবে সত্য কিছু বিষয় জানাই যথেষ্ট। এটা বলা ভুল হবে যে প্লেটোর স্বরূপতত্ত্বকে অস্বীকার করার কারণে এরিস্টটলের কাছে পুরো বিশ্বটাই ঘটনাচক্রজাত (contingent) হয়ে গিয়েছিল। বরং তার Posterior Analytics গ্রন্থের শেষ অধ্যায়গুলো থেকে জানা যায় এরিস্টটল প্লেটোর অদেখা উৎকৃষ্ট রূপকে এমন কিছু দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছেন যা মানব মন বিভিন্ন বস্তুর মাধ্যমে উপলব্ধি করতে সক্ষম।

এরিস্টটল তার উদ্দেশ্যবাদেও (Teleology) প্লেটোর স্বরূপতত্ত্বকে নিয়ে আসেন। প্লেটোর মতে প্রতিটি জিনিস তাদের আসল রূপের ত্রুটিপূর্ণ প্রতলিপি, কিন্তু এরিস্টটল বললেন সকল জীবন্ত জিনিস অপূর্ণ অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে পূর্ণতর অবস্থায় উন্নীত হয়—যেমন বীজ থেকে গাছ, ভ্রুণ থেকে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী—, এবং তারপর প্রজননের কাজ শেষ করে তারা আবার ক্ষয়ে যায়, বা মারা যায়। কিন্তু সকলেই একই পরিমাণ পূর্ণতা লাভ করে না, অনেকে সেই পর্যায়ে পৌছাবার আগেই মারা যায় বা অন্য কোনভাবে বিকলাঙ্গ বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। তাই মানুষের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পূর্ণতার পর্যায়ে পৌঁছাবার জন্য সর্বোৎকৃষ্ট উপায় বা অবস্থা খুঁজে বের করা, বাগানের মালি গাছের জন্য যা চেষ্টা করে, মানুষের জন্য এই প্রচেষ্টা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখন পরবর্তী প্রশ্ন হচ্ছে কী ধরনের বা কতটুকু পূর্ণতা মানুষ অর্জন করতে পারে। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে এরিস্টটল দেখলেন মানুষের জন্য সম্ভাব্য সকল কিছুর মধ্যে কেবল কয়েকটিই ব্যক্তিমানুষ অর্জন করতে পারে। প্রত্যেক বিড়াল কাজেকর্মে একরকম, অন্যদিকে মৌমাছি বা উঁইপোকার মধ্যে কর্মী, সৈনিক ও রাণী হিসেবে সুনির্দিষ্ট কিছু ভাগ আছে। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে এই কার্যবিভাগ অনেক বেশি সূক্ষ্ণ ও বৈচিত্র্যময়। কিছু মানুষ বিশেষ প্রতিভা নিয়ে জন্মায় এবং তারা সুখী হয় এবং সমাজে সর্বোচ্চ অবদান রাখতে পারে কেবল যদি তাদেরকে সেই প্রতিভা কাজে লাগাতে দেয়া হয়, আবার কিছু মানুষ এমন বিশেষ প্রতিভা নিয়ে জন্মায় না বরং নিজেদেরকে একাধিক বিষয়ের সাথে সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। এই খাপ খাইয়ে নেবার ক্ষমতাই মানব প্রজাতিকে অন্যান্য প্রাণীদের চেয়ে সুবিধা দেয়, কিন্তু এর ফলে একজন ব্যক্তিমানুষের পক্ষে মানব প্রজাতির সম্ভাব্য সর্বোচ্চ পূর্ণতা অর্জন করা কখনোই সম্ভব হয় না।

মানুষের অভিযোজন ক্ষমতার আরেকটি অসুবিধার দিক হল অন্যান্য প্রাণী প্রকৃতিগত কারণে সীমাবদ্ধ বলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে শুধুমাত্র বাইরের কোন উপাদান দ্বারা, কিন্তু মানুষের যেকোন ধরনের সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা থাকায় সে প্রায়ই নিজের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সব মানুষের মূল লক্ষ্য থাকে সুন্দর ও সফল জীবন। কিন্তু ছোট ছোট অনেক লক্ষ্যকে কেবলমাত্র তখনই বিচক্ষণ হিসেবে ধরা যায় যখন তা উচ্চতর কোন উদ্দেশ্য অর্জনে কাজে লাগে। যেমন প্রয়োজনের চেয়ে বেশি জুতো উৎপাদন বা কেনাকে বিচক্ষণ বলে ভাবা হয় না, তা সহজেই বোঝা যায়। অপরদিকে, সীমাহীনভাবে অর্থ পুঞ্জীভূত করাটাকে ভাল হিসেবে ভাবা হয়। কিন্তু তা করতে গিয়ে মানুষ নিজের ও সমাজের উভয়েরই ক্ষতি করে, কারণ এই সংকীর্ণ লক্ষ্য অর্জন করতে গিয়ে তারা আত্মাকে বৃহত্তর অনুভব থেকে বঞ্চিত করে। একইভাবে, বৃহত্তর চিন্তাভাবনার অধিকারী মানুষের এমন নির্দেশ দেয়ার ক্ষমতা থাকা উচিত যার ফলে সেসব চিন্তাভাবনাকে কার্যে পরিণত করা যায়। এ ধরনের উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য ক্ষমতা একটি উত্তম জিনিস। কিন্তু ক্ষমতার লোভ দুর্বলের জন্য পীড়াদায়ক হয়, এমনকি অত্যাচারীর নিজের জন্যও কারণ সে শোষিতের কাছে ঘৃণ্য হয়। এসব ত্রুটির কারণে মানুষ বাধাহীনভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও ফলপ্রসূ কাজ করতে পারে না। তাদের প্রয়োজন হয় বিশ্রাম, খেলাধুলা বা বিনোদনের। প্রয়োজন মানুষকে সহ্যসীমার বাইরে কাজ করতে বাধ্য করে বলে মানুষ অনেক সময় মনে করে অবিরত বিনোদনের জীবন সবচেয়ে সুখকর, কিন্তু আদতে এর চেয়ে ক্লান্তিকর বোধহয় আর কিছুই নয়!

এরিস্টটলে উদ্দেশ্যবাদ পুরোপুরি অভিজ্ঞতালব্ধ পর্যবেক্ষণের উপর প্রতিষ্ঠিত। এটি কোন দৈব সত্তার অস্তিত্বের উপরও নির্ভরশীল নয় আবার কার্যকারণ নীতির লঙ্ঘনও নয়। এটি এরিস্টিটটলের নৈতিক ও রাজনৈতিক মতবাদের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। এরিস্টটল অভিজ্ঞতালব্ধ প্রমাণ সংগ্রহের উপর আস্থাশীল ছিলেন। একবার তিনি তার শিষ্যদেরকে পরিচিত সকল শহর ও দেশের আইন এবং রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর কার্যপদ্ধতি ও তাদের প্রবর্তকদের ভুলগুলো পর্যালোচনা করতে বলেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে এরিস্টটলকে গোঁড়া দার্শনিক হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়, কারণ পরবর্তী যুগগুলোতে অনেক সময়ই তার মতবাদগুলোকে একরকম সন্দেহাতীত হিসেবেই মেনে নেয়া হতো,  বা নিতে হতো। প্রকৃত অর্থে এরিস্টটল ছিলেন সর্বকালের সেরা অভিজ্ঞতাবাদীদের একজন।

এরিস্টটলের মৃত্যুর পর তার শিষ্যরা একই ধরনের কাজ জারি রাখেন, বিশেষ করে ইতিহাসের ক্ষেত্রগুলোতে: থিওফ্রাস্টাস (Theophrastus) দর্শন, উদ্ভিদবিদ্যা ও ধাতুবিদ্যার নানা কাজের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন, এউদিমোস (Eudemus of Rhodes, জী. খ্রিস্টপূর্ব আ. ৩৭০–৩০০) গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার ইতিহাস লেখেন, মিনো (Meno) চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাস লিখেন, এবং দিকাইয়ার্কোস (Dicaearchus of Messene, জী. খ্রিস্টপূর্ব আ. ৩২০) সভ্যতার ইতিহাস ও রাজনৈতিক শাসনতন্ত্রের শ্রেনিবিভাগের উপর একটি বই লিখেন। পেরিপ্যাটেটিকদের পরবর্তী দুই প্রজন্ম মূলত দুই দিকে ছড়িয়ে পড়ে: একদল সাহিত্যের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে কবিতা, মহাকাব্য, বিয়োগান্তক সাহিত্য ও প্রহসনের ইতিহাস এবং বিখ্যাত লেখকদের জীবনী লেখার মধ্য দিয়ে, এবং আরেক দল ভৌতবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করে। স্ত্রাতোন (Straton of Lampsacus, মৃ. আ. খ্রিস্টপূর্ব ২৭০) পরীক্ষণের উপর ভিত্তি করে নতুন ধরনের পদার্থবিদ্যার জন্ম দেন, এবং বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ আরিস্তার্কোস (Aristarchus of Samos, খ্রিস্টপূর্ব ৩১০–২৩০) কোপার্নিকাসের প্রায় আঠারশ’ বছর আগেই একটি সৌরকেন্দ্রিক জগতের মডেল উত্থাপন করেন। এসব মতধারা পরবর্তীতে ঝিমিয়ে পড়লেও ১০০ খিস্টাব্দে এরিস্টটলের পাণ্ডুলিপিসমূহ পুনরাবিস্কৃত হবার পর সেগুলোর ভাষ্যকার হিসেবে একটি দলের উদ্ভব ঘটে যা মধ্যযুগীয় দর্শনের উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে।

হেলেনীয় ও রোমান দর্শন

এরিস্টটলের মৃত্যুর পরবর্তী সময়টাকে চিহ্নিত করা হয়েছে গ্রিক নগররাষ্ট্রের পতনের সময় হিসেব, যেগুলো আলেকজান্ডার-পরবর্তী রাজাদের ক্ষমতার খেলায় দাবার ঘুটি হয়ে উঠেছিল। জীবন হয়ে পড়েছিল অনিশ্চিত। এই পরিবেশেই দুটি গোঁড়া দার্শনিক মতবাদের জন্ম হয়: স্টয়িকবাদ (Stoicism) ও এপিকুরোসবাদ (Epicureanism)।

স্টয়িকবাদ

সীরিয় দার্শনিক কিতিয়নের জিনো (Zeno of Citium, খ্রিস্টপূর্ব আ. ৩৩৫–আ. ২৬৩) স্টয়িকবাদের উদ্ভাবক। বণিক জিনো এথেন্স যাওয়ার পথে সমুদ্রে তার সর্বস্ব হারান, তখন সিনিক দার্শনিক ক্রাতিস (Crates of Thebes, জী. খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতক) তাকে শেখান জাগতিক কোন কিছুই মানুষের সুখের জন্য প্রয়োজনীয় নয়। ফলে জিনো এথেন্সেই থেকে যান, বিভিন্ন দার্শনিকের বক্তৃতা শোনেন এবং একসময় তার নিজের মতবাদ প্রচার শুরু করেন। Stoa Poikile নামের একটি হলে তিনি বক্তৃতা দিতেন বলে তা থেকেই তার দর্শনের নাম হয়ে যায় Stoicism।

একটি গোঁড়া সক্রেটিক মতবাদের সাথে হেরাক্লিতোসের দর্শন থেকে কিছু উপাদান মিলিয়ে জিনো তার মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। মানুষের সুখের ভিত্তি হচ্ছে ‘নিজের সাথে সমঝোতা করে বেঁচে থাকা’, যে উক্তিটি পরবর্তীতে প্রতিস্থাপিত হয় ‘প্রকৃতির সাথে সমঝোতা করে বেঁচে থাকা’ দিয়ে। মানুষের জন্য সত্যিকারের ভাল ব্যাপার হচ্ছে সদ্গুণের (virtue) অধিকারী হওয়া, এছাড়া বাকি সবকিছু—সম্পদ বা দারিদ্র, স্বাস্থ্য বা জরা, জীবন বা মৃত্যু—এসবই গুরুত্বহীন। সকল সদ্গুণের একমাত্র ভিত্তি হচ্ছে সঠিক জ্ঞান, আত্মনিয়ন্ত্রণ হচ্ছে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে জানা, সহিষ্ণুতা হচ্ছে কোনটা সহ্য করতে হবে আর কোনটা নয় তা জানা এবং ন্যায়বিচার হচ্ছে সঠিক জ্ঞানের বণ্টন। কেন খুন, জালিয়াতি বা চুরি অসৎ গুণ হিসেবে বিবেচিত হবে আর কেনই বা জাগতিক সম্পদকে মূল্যহীন ধরা হবে তা বুঝাটা কঠিন ছিল বলে পরবর্তীতে এ মতবাতটি সংশোধন করে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়: ‘বাঞ্ছনীয় জিনিস’ (যেমন জীবন ও সুস্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তা), ‘পুরোপুরি প্রভাবহীন জিনিস’ এবং ‘অবাঞ্ছিত জিনিস’; যদিও তারপরেও দাবি করা হতে থাকে যে সত্যিকারের প্রাজ্ঞ ব্যক্তির সুখকে জরা, বেদনা, ক্ষুধা বা কোন বহিঃস্থ বস্তুর অভাব দিয়ে প্রভাবিত করা যায় না। শুরুতে জিনো দাবি করেছিলেন ব্যক্তি হতে পারেন প্রাজ্ঞ (যিনি কখনোই অন্যায় করবেন না, এবং পুরোপুরি সুখী হবেন) অথবা বোকা। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি এ বক্তব্য সংশোধন করে বলেন কিছু মানুষ আছে যারা সম্পূর্ণরূপে প্রাজ্ঞ নন, কিন্তু তারা প্রজ্ঞা অর্জনের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন। যদিও তারা অন্তর্নিহিত সূক্ষ্ণদৃষ্টির অধিকারী কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের এ শক্তি সম্পর্কে নিশ্চিত নন, কারণ একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি নিজের অন্তর্নিহিত সূক্ষ্ণদৃষ্টি সম্পর্কে অবগত থাকবেন। তিনি আরো দাবি করেন আমাদের জগৎ নিয়ন্ত্রিত হয় ‘লোগোস’ (logos) দিয়ে; যে শব্দটির আদি অর্থ ছিল ‘কথা’, কিন্তু পরবর্তীতে হেরাক্লিতোসের মাধ্যমে এর অর্থ হয় ‘মহাবিশ্বের নীতি প্রকাশক কথা’ এবং পরিশেষে এ শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় ‘যুক্তি’। তিনি বলেন লোগোস বিশ্বকে সুশৃঙ্খল করে রাখে। মানুষ এই নিয়ম থেকে সরে যেতে পারে বা এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে, কিন্তু তাতে এ শৃঙ্খলা ভঙ্গ হয় না বরং মানুষ এর ফলে শুধুমাত্র নিজের ক্ষতিই ডেকে আনে।

জিনোর দর্শনের পরবর্তী বিকাশ ঘটে এ মতধারার দ্বিতীয় কর্ণধার ক্লেয়ান্থিস (Cleanthes, খ্রিস্টপূর্ব আ. ৩৩১–আ. ২৩২) এবং তৃতীয় কর্ণধার ক্রিসিপোসের (Chrysippus, খ্রিস্টপূর্ব আ. ২৮০–আ. ২০৬) হাত ধরে। ক্রিসিপোস ‘প্রস্তাবনামূলক যুক্তি’ (propositional logic) নামে একটি নতুন ধরনের যুক্তি প্রবর্তন করেন যা সাম্প্রতিক কালের আগে শুধুমাত্র স্টয়িক সম্পদায়ের মধ্যেই প্রচলিত ছিল; কিছু যুক্তিবাদী এই মতবাদকে এরিস্টটলের ‘ধারণাগত যুক্তির’ (conceptual logic) চেয়েও উপরে স্থান দেন। পানাইতিওস (Panaetius of Rhodes, খ্রিস্টপূর্ব আ. ১৮০–১০৯) স্টয়িক দর্শনকে পাল্টিয়ে রোমান অভিজাতদের (যারা তখন পাশ্চাত্য বিশ্ব শাসন করতেন) জন্য যুৎসই করে তোলেন এবং সেই সময়ের অগ্রগণ্য কিছু মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করেন যারা তার নৈতিক আজ্ঞা অনুসরণ করার চেষ্টা করতেন। পরবর্তী শতকে গৃহযুদ্ধ, দাসবিদ্রোহ এবং রোমান প্রজাতন্ত্রের পতনের সময় সর্বকালের অন্যতম সেরা ইতিহাসবিদ পসাইদনিওস (Poseidonius of Apamea, খ্রিস্টপূর্ব আ. ১৩৫–আ. ৫১) স্টয়িকদের অন্য সকল মানুষের উপরে স্থান দেন, যেহেতু তার মতে স্টয়িকরা মানবজাতির দ্বন্দগুলোকে দর্শকের মত পর্যবেক্ষণ করে। রোমান সাম্রাজ্যের একত্রীকরণের সময় স্টয়িকবাদ প্রজাতন্ত্রপন্থীদের ধর্ম হয়ে দাঁড়ায়। সবচেয়ে বিখ্যাত স্টয়িক ছিলে কাতো (Cato, খ্রিস্টপূর্ব ৯৫–৪৬), যিনি জুলিয়াস সিজারের বিজয়ের পর আত্মহত্যা করেন। সম্রাট নিরোর শিক্ষক এবং উপদেষ্টা সেনেকা’র (Seneca the Younger, খ্রিস্টপূর্ব আ. ৪–খ্রিস্টাব্দ ৬৫) জন্যও পথপ্রদর্শক হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই দর্শন। সেনেকা সম্রাট নিরোকে সৎপথে পরিচালিত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন এবং অবশেষে নিরোর আদেশে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। জিনোর মূল মতবাদের নানা অস্বাভাবিকতা সত্ত্বেও প্রাচীন যুগের শেষ দিকে এবং পরবর্তীতেও স্টয়িকবাদ অনেক মানুষের চিন্তায় প্রশান্তি ও সহিষ্ণুতার শক্তি সঞ্চার করেছিল।

এপিকুরোসবাদ

সমসাময়িক দার্শনিক এপিকুরোস (Epicurus, খ্রিস্টপূর্ব ৩৪১–২৭০) জিনোর দর্শনের বিপরীতধর্মী একটি মতবাদ উদ্ভাবন করেন। জিনো মনে করতেন একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি সর্বদা অন্যদের কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করেন এবং পূর্বসূরিদের ঋণ স্বীকার করেন, কিন্তু এপিকুরোস তার মতবাদকে সম্পূর্ণ মৌলিক বলে দাবি করেন। স্টয়িকরা যেখানে প্রচার করেছিলেন বেদনা বা সুখ জীবনের উপর প্রভাবহীন, সেখানে এপিকুরোস দাবি করেন আনন্দই সুখী জীবনের সারকথা। স্টয়িকরা শুরু থেকেই রাজা এবং শাসকদের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন কিন্তু এপিকুরোস তার অনুসারী ব্যতীত অন্যদের সাথে মেলামেশা থেকে বিরত থাকতেন। স্টয়িকরা দৈব সত্তায় বিশ্বাস করতেন কিন্তু এপিকুরোস মনে করতেন মানুষের ব্যাপারে ঈশ্বরের কোন মাথাব্যথা নেই। এত বৈপরীত্য সত্ত্বেও দুটি দর্শনের মধ্যে কিছু মিল পাওয়া যায়। এপিকুরোস আনন্দলাভকে জীবনের সারবস্তু বলেছিলেন কিন্তু তিনি ছিলেন অমিতাচারের বিরোধী। তিনি মনে করতেন সহজ সরল আনন্দময় বিষয়গুলোই জীবনে সুখ এনে দেয়। বৃদ্ধ বয়সে প্রস্টেটাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণার মাঝেও দর্শনচিন্তা এবং বন্ধুদের স্মৃতি ও সাহচর্য তাকে আনন্দ দিত। এপিকুরোন নাস্তিক ছিলেন না। তার রোমান ভক্ত কবি লুক্রেতিউস (Lucretius, জী. খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতক) দে রেরুম নাতুরা (“বিশ্বপ্রকৃতি”) কবিতায় এপিকুরোসের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে তাকে সকল প্রকার ধর্মীয় ভীতি থেকে মুক্তকারী হিসেবে আখ্যা দেন, এপিকুরোস নিজেও একে তার দার্শনিক মতবাদের লক্ষ্য হিসেবে স্থির করেছিলেন। এপিকুরোস বলতেন দেবতা বা ঈশ্বরের মতো উচ্চতর সত্তার মানুষকে নিয়ে চিন্তিত হবার কোন কারণ নেই, কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের জন্য এমন উচ্চতর পূর্ণাঙ্গ সত্তার ধারণা প্রয়োজনীয় যা থেকে মানুষ পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা পেতে পারে। কিন্তু রোমান শাসনামলে এপিকুরোসীয় মতবাদকে নাস্তিক্য মতবাদ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয় এবং প্রচার করা হয় এপিকুরোসবাদ উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনকে উৎসাহিত করে। সেনেকা এপিকুরোসের দর্শনের মূলভাব বুঝতে পেরেছিলেন, তাই তার রচিত Epistulae morales-এ (“নৈতিক পত্রাবলি”) স্টয়িক মতবাদের আলোচনার মধ্যে এপিকুরোসের অনেক বচনও ব্যাখ্যা করেন।

সংশয়বাদ

জিনোর সমসাময়িক আরেক দার্শনিক পিরো (Pyrrhon of Elis, খ্রিস্টপূর্ব আ. ৩৬০–আ. ২৭২) ‘সংশয়বাদ’ নামে আরেকটি হেলেনীয় মতবাদের জন্ম দেন। পিরো হেলেনীয় দর্শন বিস্তারিতভাবে সংরক্ষণের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি মনে করতেন যেহেতু কোন বিষয়েই পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়, সেহেতু কারো পক্ষে এটা বুঝাও সম্ভব নয় তার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ সত্যি না কি মায়া। পিরো এমন দৃঢ়ভাবে এই কথাগুলো বিশ্বাস করতেন যে তিনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় যানবাহন বা অন্য কোন প্রতিবন্ধকতা খেয়াল করতেন না, ফলে তার অনুসারীদের খেয়াল রাখতে হতো যাতে তিনি কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হন। পিরো পরবর্তী একজন অনুসারী সেক্সতুস এম্পিরিকুস (Sextus Empiricus, জী. ৩য় শতক) তার Pros dogmatikous (“Against the Dogmatists”) নামক গ্রন্থে সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী দার্শনিকদের মতবাদকে খণ্ডন করার চেষ্টা করেন, আর তা করতে গিয়ে তিনি পূর্ববর্তী সেই দার্শনিকদের চিন্তাগুলো ব্যাপক হারে উদ্ধৃত করেন, যার ফলে সেগুলো চমৎকারভাবে সংরক্ষিত হয়ে যায়। উল্লেখ্য, ১৮ শতকের ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদী ডেভিড হিউম (১৭১১–৭৬) এবং ইমানুয়েল কান্ট (১৭২৪–১৮০৪) প্রাচীন যুগের দর্শন সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন সেক্সতুস এম্পিরিকুসের সংকলন থেকে।

নব্য-পিথাগোরাসবাদ ও নব্য-প্লেটোবাদ

খ্রিস্টপূর্ব ৪ শতক থেকে প্রাচীন যুগের শেষ পর্যন্ত যেসব দার্শনিক মতবাদের উদ্ভব ঘটেছিল তার সবগুলোর প্রচার বন্ধ হয়ে যায় সম্রাট জাস্টিনিয়ান-প্রথমের (৪৮৩–৫৬৫) আদেশে; ৫২৯ খ্রিস্টাব্দে এসব দর্শনকে পৌত্তলিকতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে তিনি এ নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর প্রায় ১০০০ বছরে কেবল দু’টি মতধারার জন্ম হয়: নব্য-পিথাগোরাসবাদ ও নব্য-প্লেটোবাদ। এই দুই মতবাদই প্রাক্তন গ্রিক মতবাদগুলোর দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল তবে নব্যপ্লেটোবাদ বেশি ঐতিহাসিক গুরুত্ব পেয়েছে। নব্যপ্লেটোবাদের প্রতিষ্ঠাতা আমোনিওস সাক্কাস (Ammonius Saccas, জী. ৩য় শতক) খ্রিস্টধর্ম ত্যাগ করে প্লেটোর মতবাদ নিয়ে পড়াশোনা করেন। তবে আমোনিওস কিছু লিখে যাননি বলে তার দর্শন পরিচিতি পায় তার বিখ্যাত শিষ্য প্লোতিনোসের (Plotinus, ২০৫–২৭০) মাধ্যমে। প্লোতিনোসও কিছু প্রকাশ করেননি। তবে তার শিষ্য পরফিরিওস (Porphyry, ২৩৪–৩০৫) ‘এনেয়াদেস’ (Enneads) নামে প্লোতিনোসের লেখাগুলোর একটি সংকলন তৈরি করেন এবং প্লোতিনোসের একটি জীবনীও প্রকাশ করেন। আমোনিওস ও প্লোতিনোসের দর্শন মূলত প্লেটো দ্বারা প্রভাবিত হলেও এতে এরিস্টটলের উদ্ভাবিত অনেক পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, এমনকি স্টয়িকবাদের অনেক উপাদানও এখানে ব্যবহার করা হয়েছে। তবুও এই দর্শনকে সেই সময়ের ধর্মীয় ও অতীন্দ্রিয় চিন্তাধারার ক্ষেত্রে একটি নতুন সংযোজন বলে ধরা যায়। প্লোতিনোস কয়েক স্তরবিশিষ্ট সত্তার উপস্থিতিতে বিশ্বাস করতেন—তার সর্বোচ্চ স্তরে রয়েছে একক বা শুভ, যা অভিন্ন কিন্তু মানুষের ভাষায় অব্যাখ্যেয়, ঠিক তার পরের স্তরেই রয়েছে nous অর্থাৎ নিখাদ বুদ্ধিমত্তা বা যুক্তি, এর পরবর্তী স্তরে রয়েছে আত্মা। এখান থেকেই শুরু হয় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ। আর সবচেয়ে নিচের স্তরে রয়েছে পদার্থ যা সকল অন্যায়ের মূল। একক বা শুভ (the One, বা the Good) সত্তার সাথে মিলিত হওয়াই সর্বোচ্চ সুখ, ধ্যান এবং শুদ্ধির মধ্য দিয়ে যে স্তরে পৌঁছানো যায়। স্টয়িক দর্শনে বর্ণিত প্রাজ্ঞ ব্যক্তির অর্জিত প্রজ্ঞা চিরন্তন, কিন্তু এখানে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছানো কোন চিরস্থায়ী অবস্থান নয়, পরফিরিওস তার জীবনীতে লিখেছে প্লোতিনোস তার জীবনে সর্বোচ্চ সুখের স্তরে পৌঁছতে পেরেছিলেন সাত বার, কিন্তু তিনি নিজে এ স্তরে যেতে পেরেছিলেন মাত্র এক বার।

নব্যপ্লেটোবাদের পরবর্তী ইতিহাস খুবই জটিল। পরফিরিওস প্লোতিনোসের দর্শনের নৈতিক বিষয়গুলোর উপর জোর দেন, অপরদিকে তার শিষ্য ইয়াম্ব্লিকোস (Iamblichus of Chalcis, আ. ২৫০–৩৩০) সিরিয়ায় নব্যপ্লেটোবাদকে নব্য-পিথাগোরাসবাদের সাথে মিশিয়ে প্রচার করেন এবং পিথাগোরীয় জীবন পদ্ধতি ও সংখ্যাতত্ত্বের উপর লেখালেখি করেন। সর্বোপরি, তিনি সত্তার স্তরগুলোকে বাড়ান এবং সর্বোচ্চ স্তরে একক সত্তার ধারণা থেকে সরে আসেন, ফলে প্রথাগত গ্রিক দেবতাদেরকে এখানে সংযোজন করা সহজ হয়ে দাঁড়ায়। পশ্চিম এশিয়া মাইনরের পের্গামামে ইয়াম্ব্লিকোসের শিষ্য আইদেসিওস (Aedesius, মৃ. ৩৫৫) শিষ্য মাক্সিমোসের (Maximus of Ephesus, মৃ. ৩৭০) সাথে মিলে নতুন মতবাদের প্রবর্তন করেন, এবং তারা প্রাচীন গ্রিক ধর্মগুলোর (যেমন, অর্ফিক ধর্ম) পুনর্জাগরণের চেষ্টা করেন। ৪র্থ শতকে সম্রাট জুলিয়ান (Julian the Apostate, আ. ৩৩১–৩৬৩) পৌত্তলিক ধর্মের পুনর্জাগরণের চেষ্টা করলে এসব মতবাদ বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পরবর্তী শতকে এথেনীয় মতধারার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন হয় যখন প্রোক্লোস (Proclus, আ. ৪১০–৪৮৫) তার পূর্বসূরিদের সকল মতবাদ একটি সামগ্রিক ব্যবস্থার অধীনে একত্রিত করেন। জাস্টিনিয়ান ৫২৯ সালে সকল এথেনীয় মতবাদ প্রচার বন্ধ করে দিলেও এর একটি ধারা সচল থেকে যায় আলেকজান্দ্রিয়ায়। এথেনীয় নব্যপ্লেটোবাদীরা পারস্যের রাজা খসরু-প্রথমের (Khosrow I, মৃ. ৫৭৯) দরবারে আশ্রয় নেন, ৫৩৫ সালে তারা এথেন্সে ফেরার অনুমতি পান। পৌত্তলিক দর্শন ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে গেলেও পরবর্তী খ্রিস্টীয় দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের বিকাশে তা ব্যাপক ভূমিকা রাখে।