১৮৩৫ সালে বিগল জাহাজে চড়ে চার্লস ডারউইন গালাপাগোস দ্বীপে গিয়েছিলেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৬ বছর। দ্বীপের বেশ কিছু পাখি তার নজর কেড়েছিল। সেই পাখিগুলোর নামের সাথে তাই ডারউইনের নাম জড়িয়ে আছে। এখনও এগুলোকে ডারউইনের ফিঞ্চ (finch) নামে ডাকা হয়। প্রকৃতিবিদরা এ ধরণের অনেকগুলো ফিঞ্চকে আগে গ্রসবিক (grosbeak) ভেবে ভুল করতেন। বর্তমানে সে ধরণের সংশয় অনেকটাই দূর হয়েছে। এই ফিঞ্চগুলোর আবিষ্কারের কাহিনীও বেশ মজার। ডারউইনের সময় ইংল্যান্ডে জন গুল্ড নামে একজন পক্ষীবিশারদ ও চিত্রকর ছিলেন। ডারউইনরা অনেক ধরণের পাখির নমুনা নিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে এসেছিলেন। গুল্ড এই সংরক্ষিত নমুনাগুলো থেকে কয়েকটির ছবি আঁকা শুরু করেন। ছবি আঁকতে গিয়ে লক্ষ্য করেন, এগুলো সবই ফিঞ্চের বিভিন্ন প্রজাতি।

আমাদের স্বশিক্ষিত প্রকৃতিবিদ ডারউইন গুল্ডের ছবিগুলো দেখে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বুঝতে পেরেছিলেন: প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ফিঞ্চদের ঠোঁটের আকার পরিবর্তিত হয়েছে। বিভিন্ন দ্বীপের ফিঞ্চরা বিভিন্ন আকারের দানা ও পোঁকা খেত। খাদ্যের আকার অনুযায়ীই তাদের ঠোঁটের আকার পরিবর্তিত হয়েছে। এই বিস্ময়কর পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে ডারউইন তার “দ্য ভয়েজ অফ দ্য বিগল” (১৮৩৯) বইয়ে লিখেছেন, “নিবিঢ়ভাবে সম্পর্কিত এক শ্রেণীর পাখির মধ্যে এই গঠনগত ক্রমবিন্যাস ও বৈচিত্র্য দেখে যে কেউ বিস্মিত হবেন। অনেকের মনে হতে পারে, এই দ্বীপপুঞ্জের স্বল্পসংখ্যক পাখি প্রজাতির কোন একটিকে নির্বাচন করা হয়েছে এবং সেই প্রজাতির বিভিন্ন পাখিকে বিভিন্নভাবে বদলানো হয়েছে।”

এর ২০ বছর পর ডারউইন ফিঞ্চদের অভিযোজন প্রক্রিয়ার একটি ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন যা “বিবর্তনবাদ” হিসেবে পরিচিত। এতে বলা হয়েছিল, ভিন্ন ভিন্ন দ্বীপে ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশের কারণেই এক প্রজাতির একেক পাখি একেক ভাবে অভিযোজিত হয়েছে। প্রাকৃতিক নির্বাচনের শক্তিই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে কেবল পরিবেশ উপযোগী বৈশিষ্ট্যগুলোকে টিকিয়ে রেখেছে। ডারউনের তত্ত্ব বিজ্ঞানী ও ধার্মিক উভয় সমাজের কঠোর সমালোচনার শিকার হয়েছে। কিন্তু এই তত্ত্ব একটি অতি সমৃদ্ধ গবেষণাক্ষেত্রের সূচন-বিন্দু মাত্র, সেই গবেষণা আজ অব্দি চলছে, এর যেন কোন শেষ নেই। বর্তমানকালের বিজ্ঞানীরাও সেই তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। জীববিজ্ঞানীরা এখনও আণবিক জগতে বিবর্তনের কার্যক্রিয়া নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা বোঝার চেষ্টা করছেন, ঠিক কিভাবে আণবিক স্কেলে প্রাকৃতিক নির্বাচন ঘটে এবং তার মাধ্যমে কিভাবেই বা নতুন প্রজাতির জন্ম হয়।

ডারউইনের সেই বিখ্যাত ফিঞ্চ পাখিরা এখনও বিজ্ঞানীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। গবেষকরা ধারণা করে নিয়েছেন, বিবর্তন প্রক্রিয়া খুব ধীরে ঘটে, এতই ধীরে যে মানুষের জীবদ্দশায় তার প্রমাণ পাওয়ার কল্পনাও করা যায় না। কোন মানব পর্যবেক্ষকের পক্ষে তাই বিবর্তন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ফিঞ্চদের নিয়ে উৎসাহ কমেনি, এমনকি এদেরকে আদর্শ গবেষণা বস্তু বানিয়ে ফেলা হয়েছে। কারণ এই প্রজাতির পাখিরা অপেক্ষাকৃত দ্রুত বংশবিস্তার করে এবং তারা সচরাচর এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যায় না।